মানব জীবনে দূর্বা ঘাসের অবদান। উপকারিতা, অপকারিতা ও বৈশিষ্ট্য।
ভালো তরমুজ চেনার উপায় কি মানবজীবনে দূর্বা ঘাসের অবদান বলে শেষ করার নয়। আপনা আপনি রাস্তার পাশে পথে-ঘাটে জন্মালেও দূর্বা ঘাসের রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। মানব দেহ কে সুস্থ রাখতে ভেষজ গুন সমৃদ্ধ এই উদ্ভিদের অবদান অনেক।
দূর্বা ঘাস দীর্ঘকাল প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। এটি দেখতে মসৃণ ও সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। দূর্বা ঘাস আলাদাভাবে চাষের প্রয়োজন হয়না। কোন রকম যত্নেরও প্রয়োজন হয়না।
পোস্ট সূচিপত্রঃ দূর্বা ঘাসের পরিচিতি
প্রচলিত বাংলা নামঃ দূর্বা ঘাস
ইংরেজি নাম ঃবারমুডা গ্রাস( Bermuda grass,Dove grass)
বৈজ্ঞানিক নামঃ Cynodon dactylon pers
আয়ুর্বেদিক নামঃ দু্ব
ইউনানী নামঃ দুব, দুর্বা
পরিবারঃPoaceae (Gramineae)
নাম পরিচিতিঃ দূর্বা ঘাস বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমনঃ ধুম, বাহামা গ্র্যস বারমুডা গ্র্যস,দুব, কোচ গ্র্যস, ডগস টুথ, ডেভিলস গ্র্যস,গ্রামা,স্কুটস গ্র্যস,ইন্ডিয়ান দোয়াব এবং আরুগাম্পুল।
দূর্বা ঘাসের বৈশিষ্ট্য
আয়ুর্বেদ অনুসারে দূর্বা ঘাসের স্বাদ কষা- মিষ্টি। এতে প্রোটিন ক্যালসিয়াম কার্বোহাইড্রেট ফাইবার ও পটাশিয়াম পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান।এই ঘাসে রয়েছে মূল বা শিকড় যা মাটির সাথে গেঁথে থাকে।এই ঘাস সাধারণত বেশি বড় হয়না এবং কোন প্রকার সাহায্য ছাড়াই নিজ থেকেই জন্মায় এবং বেড়ে উঠতে পারে।
দূর্বা ঘাস কোথায় জন্মায়
মানবজীবনে দূর্বা ঘাসের অনেক অবদান রয়েছে। এই অতি প্রয়োজনীয় উদ্ভিদটি আপনার বাড়ির আশেপাশে ,আনাচে-কানাচে রাস্তার পাশে, মাঠে- ঘাটে জঙ্গলে বাগানে কোথায় নেই ?সব জায়গায় এর উপস্থিতি।যেখানে কোন উদ্ভিদ জন্মাতে পারেনা সেখানেও রয়েছে এর উপস্থিতি।যার ফলে দূর্বা ঘাস চিনেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
দূর্বা ঘাস চাষ করার প্রয়োজন হয়না।কেননা এটি শত অযত্ন অবহেলাতেও যেখানে সেখানে অবলিলায় গজিয়ে ওঠে'।তবে অধিক সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য আজকাল ক্ষুদ্র পরিসরে এর চাষাবাদ শুরু
আরও পড়ুনঃ মানুষ মাদকাসক্ত কেন হয়
বিভিন্ন খাতে দূর্বা ঘাসের উপকারিতা
রক্ত ক্ষরণ রোধ করেঃ শরীরে কেটে গেলে বা আঘাত জনিত কারনে রক্ত ক্ষরণ হলে সামান্য পরিমান দূর্বা ঘাসের সাথে কয়েক ফোঁটা পানি মিশিয়ে হাতের তালুতে বা অন্যকোন উপায়ে পিষে কাটা স্থানে বেঁধে দিলে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়। এতে ক্ষতস্থান দ্রুত শুকিয়ে যায় ও জোড়া লাগে।এতে দূর্বার শিকড় ব্যবহার করলে আরও বেশি উপকার পাওয়া যায়।
অস্বাভাবিক ঋতুস্রাবের ক্ষেত্রে
যাদের অধিক বা অস্বাভাবিক ঋতুস্রাবের সমস্যা রয়েছে তারা, প্রতিদিন দূর্বা ঘাসের রস দুই থেকে তিন চামচ নিয়ে সাথে কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে খেলে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এর উপকার বুঝতে পারবেন। তাছাড়াও দূর্বা ঘাসের ক্বাথ জরায়ুর মাংসপেশীর শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। প্রসূতি মায়েদের বুকের দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে ও পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের ক্ষেত্রেও দূর্বা ঘাস উপকারী।
বমি ভাব কাটাতে
বমি বমি ভাব বন্ধ করার জন্য দুর্বা ঘাসের রস দুই থেকে তিন চামচ ও এক চামচ চিনি সহকারে প্রতি ঘন্টায় একবার করে খেলে বমি ভাব কেটে যাবে।
চুল পড়া রোধে
যাদের মাথার চুল খুব পড়ছে বা ঝরে যাচ্ছে তাদের জন্য দুর্বা ঘাস হতে পারে মহৌষধ। একটি পাত্রে নারিকেল তেল মৃদু আঁচে জ্বাল করে নিতে হবে। তারপর দুর্বা ঘাসের টাটকা রস 200 মিলির তেলের সাথে মিশিয়ে পুনরায় জাল দিয়ে নিয়ে নামিয়ে ছেকে নিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
গোসলের এক ঘন্টা আগে ওই তেল মাথায় মেখে চুল ধুয়ে নিতে হবে। নিয়মিত দুই থেকে তিন মাস ব্যবহার করলে চুল পড়া, চুল ঝরা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।
চর্মরোগ,পাইলস ও চোখের সংক্রমনে উপকারিতাঃদূর্বা ঘাসের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিসেপটিক ও এন্টি ইনফ্লামেটরি বৈশিষ্ট্য। চর্ম রোগে ফুসকুড়ি , চুলকানি, একজি্মা, বিখাউজ ,কুষ্ঠ, বিবর্ণতা ইত্যাদি প্রতিরোধে দূর্বা ঘাস উপকারী।
আরও পড়ুনঃসাদা ফুলের গন্ধ বেশি হয়
দূর্বা ঘাসের নানান রকম ব্যবহার
১০ মিনিট অল্প আছে এক কাপ গরুর দুধের সাথে পরিমাণ মতো দুর্বার ঘাস গরম করে অতঃপর ঠান্ডা করে পান করলে পাইলস রোগ উপশম হয়।
চোখের সংক্রমণে যেমন- জ্বালাপোড়া কঞ্জাংটিভাইটিস বা চোখ উঠার ক্ষেত্রে দুর্বা ঘাস উপকারি।এ ক্ষেত্রে দূর্বা ঘাস জ্বাল দিয়ে পানি ব্যবহার করা যায়।
এছাড়াও দূর্বা ঘাসের রস সেবনে স্নায়ুতন্ত্র ছন্দময় রাখতে সহায়তা করে।এই রস সেবনে মৃগী রোগীর খিচুনি , মানুষিক বিকারগ্রস্ততা সারাতে এর জুড়ি মেলা ভার।
আমাশয় ,ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতেঃ
যাদের পুরাতন আমাশয় রয়েছে , যারা দীর্ঘদিন ধরে আমাশয়ে ভুগছেন তাদের জন্যও রয়েছে এর দারুন টনিক। দুই তিন চামচ দূর্বা ঘাসের রসের সাথে চার থেকে পাঁচ চামচ ডালিম পাতা বা ছালের রস মিশিয়ে দিনে তিন থেকে চারবার খেতে হবে ।এভাবে প্রতিদিন খেলে পনের দিনের মধ্যে আমাশয় ভালো হয়ে যাবে।
মানব জীবনে দুর্বা ঘাসের অবদান অনেক।যেমন-ধর্মীয় ক্ষেত্রে ঃ শুধু অসুখ সারাতেই নয় বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানেও দূর্বা ঘাসের কদর রয়েছে যেমন-পূজা অর্জনাতে দুর্বা ঘাসের গুরুত্বঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা অর্চনার সময় দূর্বা ঘাসের প্রচলন রয়েছে। তারা ফুল ,পাতা,বাতি বা বিভিন্ন ফলের মাঝে পূজা অর্চনার সামগ্রীতে দুর্বাঘাস যোগ করে থাকে। পূজা অর্চনায় দুর্বা ঘাস হল পবিত্রতার প্রতীক।
খ্রিস্টানদের ধর্মীয় বিভিন্ন উৎসবে তাদের রীতি অনুসারে অন্যান্য সামগ্রীর পাশাপাশি দূর্বা ঘাসের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে হরেক রকম ফুল পাতা ও দুর্বা ঘাস অন্যতম।
বৌদ্ধ মন্দিরেও পূজা অর্চনার ক্ষেত্রে ফুল পাতার পাশাপাশি দূর্বা ঘাসের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।
বিবাহ অনুষ্ঠানেঃ বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিবাহ অনুষ্ঠানে দূর্বা ঘাসের প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে আদিবাসীদের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে এই সংস্কৃতি প্রচলিত আছে।এমনকি বাঙালি সংস্কৃতিতেও এটির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। মানব জীবনের দুর্বা ঘাসের অবদান অনেক।
আদিবাসী সংস্কৃতিতে দূর্বা ঘাস গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ডালা সাজাতে দূর্বা ঘাস অপরিহার্য। নতুন বউ বরকে বরণ করে নিতে সাজানো ডালাতেও দূর্বা ঘাসের বিকল্প নেই।
বাড়ি ঘরের আলপনাতে দূর্বা ঘাসের ব্যবহারঃ বিশেষ করে আদিবাসীদের বাড়ির দেয়ালে বিভিন্ন কারু কাজ লক্ষ্য করা যায়। এখানেও বিশেষ স্থান দখল করে আছে দূর্বা ঘাস সহ অন্যান্য ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। তাছাড়া ও বিভিন্ন পার্বণে দূর্বা ঘাস দিয়ে বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়।
ফুলের তোড়াতেও ব্যবহারঃ মানব জীবনে দুর্বাসের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। বিভিন্ন প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে পছন্দের মানুষকে আমরা ফুল উপহার দিতে পছন্দ করি ।..সেই ফুলের সাথে মিলিয়ে দূর্বা ঘাসের সমন্বয় করেও তোড়া বানিয়ে নিতে পারি। যা দেখ তে একটি অন্যরকম কিন্তু বেশ সুন্দর লাগবে।
ফুলের পাশাপাশি আমরা দুর্বা ঘাস দিয়েও মেয়েদের খোপা সাজাতে দেখি যা দেখতে সত্যিই মনোমুগ্ধকর।কারো কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এই দূর্বা ঘাস কোথায় পাওয়া যায়? এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।যারা শহরে বসবাস করে, যারা কখনো গ্রামে যায়নি, তারা হয়তো বা শহরের ইট কাঠের দালান কোঠা ছাড়া উন্মুক্ত মাঠ দেখার সৌভাগ্য লাভ করেনি।
মানব জীবনে দুর্বা ঘাসের যে অনেক অবদান রয়েছে, তা হয়তোবা তারা জানেই না।।তাদের উদ্দেশেই বলি, অতি প্রয়োজনীয় উদ্ভিদটি আপনার বাড়ির আশেপাশে আনাচে-কানাচে রাস্তার পাশে, মাঠে ঘাটে জঙ্গলে বাগানে সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়।শুধু চিনে নিতে পারলেই হল।চিনে নিয়ে এর ব্যবহারে আপনার বেশ উপকার হবে।
অপকারিতা
এতক্ষণ আমরা দেখলাম দুর্গা ঘাসের বিভিন্ন উপকারিতা। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে দূর্বা ঘাসে কি শুধু উপকারীতা রয়েছে এর কি কোন অপকারিতা নেই? উত্তরে বলতেই হয় যেখানে উপকারিতা রয়েছে, সেখানে কিঞ্চিত হলেও অপকারিতা থাকবেই।
যেমন-নিয়ম মেনে এর রস খেলে যেমন আমাশয় , ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় তেমনি এর অতিরিক্ত সেবনে পিত্তথলিতে পাথর হতে পারে। কারণ দূর্বা ঘাসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি।এছাড়াও এর রস শীতল হওয়ার কারনে এর সেবনে শরীরের ক্লান্তি ভাব যেমন দূর হয় তেমনি অতিরিক্তি সেবনে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে পারে।
বিশেষ সতর্কতা
উপরে উল্লেখিত পরামর্শ গুলো অনুসরণ এর আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত এ তথ্যের বাস্তবিক প্রয়োগ কাম্য নয়।
শেষ কথাঃ আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, মানব জীবনে দুর্বা ঘাসের অবদান অনস্বীকার্য। ক্ষুদ্র একটি উদ্ভিদ কিন্তু এর যে নানাবিধ ব্যবহার ও এর উপকারিতা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। যতই বলি না কেন ,কোন কিছু আশা না করে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মানব সমাজের যে উপকার করা যায় এই ছোট্ট উদ্ভিদ থেকে আমরা তা শিখে রাখতে পারি।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url